Wednesday, November 23, 2016

ধর্ম, অর্থ,কাম ও মোক্ষ

মানব জীবনে চারটি বিষয় অতি জরুরী, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। আসুন আমরা সবাই এই্ চারটি বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ভাবে বোঝার চেষ্টা করি।

ধর্ম:

ধর্ম শব্দের অর্থ যা মানুষকে ধারন করে। প্রশ্ন কে আমাদেরকে ধারন করে আছেন? উত্তর আত্মা আমাদেরকে ধারন করে আছেন। কারন আত্মা থাকলে আমরা জীবিত থাকি আর আত্মা না থাকলে আমরা মৃত্যু বরণ করি। সুতরাং সেই ভিত্তি সত্ত্বা আত্মাকে জানাই আমাদের প্রধান কাজ।

তাঁকে তো জানবো কিন্তু তিনি থাকেন কোথায় ? বেদ বলছেন তিনি প্রত্যেক জীবের হৃদয়ে আবস্থান করেন । তাহলে তাঁকে পেতে গেলে আমাদেরকে মনের অভ্যন্তরে যেতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মন সহ সকল ইন্দ্রিয়গন সর্বদা বর্হিমুখী। তাই বর্হিমুখী সকল ইন্দ্রিয়কে অন্তরমুখী করতে বেদ কিছু প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন যাকে সাধনা বলা হয়। এই সাধনার দ্বারাই মানুষ তাঁর মধ্যে বসবাসরত আত্মাকে লাভ করতে পারবেন, যা ব্রহ্ম স্বয়ং। অতএব স্বীয় সত্ত্বাকে লাভ করবার জন্য বেদের যে বিভিন্ন ব্যবস্থা বা বিধান তাই ধর্ম।

অর্থ:

অর্থ মানব জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ যতদিন আমাদের দেহের অস্তিত্ব আছে এবং সেই দেহকে নিয়ে এই জগতে বাস করতে হবে ততোদিন অর্থ লাগবেই , এমনকি আমরা বলতে পারি অর্থ ছাড়া জীবনকে কল্পনাও করা যায় না।

কিন্তু আমাদের একটা ভুল ধারনা আছে যে অর্থ আমাদের আধ্যাত্মিক পথের বাঁধা। এটি সম্পুর্ণ ভুল ধারনা। কেননা তাই যদি প্রকৃতির নিয়ম হতো তাহলে অর্থের প্রতি আমাদের এতো গুরুত্ব কোন ভাবেই হতো না। এছাড়াও কিছু উদাহরনকে চিন্তন করুন যেমন - ভগবান শ্রীরাম, শ্রী কৃষ্ণ সবাই রাজার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এবং নিজেরাও রাজা ছিলেন। আবার ধর্ম রাজ যা পৃথিবীতে শুধু একজন সেই যুধিষ্ঠিরও সম্রাট ছিলেন। সুতরাং অর্থ আধ্যাত্মিক পথের বাধা নয় । তবে একটি বিষয় সর্বাদ মনে রাখতে হবে, আমার উপার্জিত অর্থ যেন সৎ পথের হয় এবং ব্যয়ও সৎ পথে হয়। তাহলে সেই অর্থ আপনাকে আনন্দ দেবে নয়তো বা তা পিড়া দেবে।

এছাড়াও অর্থ ব্যাপারে আমাদেরকে একটু সাবধান থাকতে হবে যে, আমরা অর্থের মালিক, অর্থ যেন আমাদের মালিক না হয়, তাহলে অর্থে অহংকার এসে যায় ও তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পরে।

কাম:

কামনাকে পূর্ণ করার জন্যই এই পৃথিবীতে আমার, আপনার সবার জন্ম। তাছাড়া কেন আমাদের জন্ম হবে বলুন? স্বীয় ভোগবাদী দৃষ্টিতে নিজের কামনা পূর্ন করলেও আধ্যাত্মিক পথেও আমরা সবাই ঈশ্বরের কামনাই পূর্ণ করছি। সেই জন্যই তো তিনি আমাদের সবাইকে বিশেষ বিশেষ গুন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে করে আমরা তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ করি। মনে রাখতে হবে, যা নিজের ও সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর সেই কামনা পূর্ণ করাই আমাদের কর্তব্য। অতএব গুন অনুসারে কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করার নামই কাম এবং এই কাম পূর্ণ করার জন্যই ভগবানের এই বিশাল সৃষ্টির রচনা করা। তাই কামপূর্ণ করা মানব জন্মের প্রধান কারন।

মোক্ষ:

আমাদের যে স্বীয় সত্ত্বা আত্মা, সেই আত্মাই পরমব্রহ্ম। সেই নির্বিকার, নিরাকার পরমব্রহ্মকে লাভ করাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। যখন এই জীবিত অবস্থায় আমরা নিজের নির্বিকার স্বরূপকে গ্রহন করতে পারবো এবং নির্বিকার থেকে জীবন-যাপন এর কর্ম সম্পাদন করতে পারবো তখনি আমাদের মোক্ষ প্রাপ্তি হবে।


Wednesday, November 2, 2016

বৈদিক দেবতা, পরমব্রহ্ম ও মুর্তিপূজা

হিন্দু ধর্ম অনুভবের উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদের উপর নয়। বৈদিক রিষিগন প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন শক্তিকে প্রথম অনুভব করেন এবং সেই ভিন্ন ভিন্ন শক্তিকে তাঁরা বিভিন্ন দেবতা রূপে উপাসনা করতে লাগেন। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিই বৈদিক যুগের বিভিন্ন দেবতা।

তারপর প্রকৃতির উপর তাঁদের গবেষনা আরও সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তাঁরা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির মধ্যে এক মহান শক্তিকে অনুভব করলেন। অর্থাৎ প্রকৃতির যে বিভিন্ন শক্তি প্রকৃত পক্ষে এগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভিন্ন কিন্তু অভ্যন্তরীন ভাবে এক মহান শক্তিরই অংশ। এই প্রকৃতির মাঝে বা সৃষ্টির মাঝে যে মহান শক্তি ক্রিয়া করছে সেই সামগ্রীক মহান শক্তিই পরম ব্রহ্ম।

যখন সৃষ্টির সামগ্রীক শক্তিই যে পরম ব্রহ্ম সুনিশ্চিত হলো মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণ বিকাশ ঘটলো। মানুষ এবার প্রত্যক্ষ দর্শন ও অনুভূতির পর জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করলো। সৃষ্টির সকল বিষয়কে জ্ঞানের দ্বারা ব্যাখ্যা করা শুরু হলো। অর্থাৎ এই সৃষ্টিতে মানুষ যা দেখছে ও অনুভব করছে তাঁর কারন ও কার্য্য খোঁজ করতে শুরু করলো। আধ্যাত্মিকতা দর্শনের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে লাগলো। এই আধ্যাত্মিকতা যখন দর্শনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা শুরু হলো তখন এলো মূর্তি পূজা।

মূর্তিপূজার দার্শনিক ব্যাখ্যা এলো এই ভাবে যে, এই সৃষ্টির সামগ্রীক শক্তি যে পরম ব্রহ্ম আসলে তাঁর সামগ্রীকতার মধ্যে কী কী খন্ড শক্তি লুকায়িত আছে। পরম ব্রহ্মের এই সামগ্রীক সত্ত্বার যে খন্ড শক্তি সেই শক্তিকে বুঝানোর জন্য প্রতীকি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলো মূর্তি, আর তাঁর সেই সত্ত্বাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনই হলো পূজা। সুতরাং ঈশ্বরীয় কোন বিশেষ সত্ত্বাকে অনুভব করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর নামই মূর্তি পূজা।

উদাহরন স্বরূপ আমরা শ্রী লক্ষ্মী দেবীকে ধরে নিতে পারি। প্রথমে আমরা লক্ষ্মী দেবীর মূর্তিকে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করি এবং তারপর তাঁর পূজার বিষয়ে জানবো।

লক্ষ্মী দেবী এক নারী বিগ্রহ, তাঁর দুটো হাত এবং তাঁর এক হাতে অর্থের প্রতীক ধান্য এবং অপর হাতে সৃষ্টির প্রতীক পদ্ম। তাঁর বাহন পেঁচা যে দিনে  অন্ধ। আমরা এর দার্শনিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।

নারী বিগ্রহের মাধ্যমে আমাদের পূর্ব পুরুষ দার্শনিকগন বুঝাতে চেয়েছেন,অর্থ সব সময় তোমার অধীনে থাকবে। অর্থাৎ সংসারে নারী যেমন পুরুষের আয়ত্তে থাকে ধ্বন সম্পদও সর্বদা তোমার আয়ত্তে থাকবে। কিন্তু তুমি যদি অর্থের আয়ত্তে চলে যাও তবে অর্থ লিপ্সু হয়ে যাবে এবং প্রকৃত মানুষ আর থাকবে না।

তিনি ধ্বন-সম্পদ বা অর্থের দেবী তাই তাঁর এক হাতে অর্থের প্রতীক ধান্য। অপর হাতে পদ্ম যা সৃষ্টির প্রতীক। অর্থাৎ কোন কিছু সমাজে সৃষ্টি করতে অর্থ প্রয়োজন।

একটি পশু তাঁর বাহন। অর্থাৎ অর্থের অহংকারে কাউকো তুচ্ছ চিন্তন করে অপরের সাথে অসৎ আচরন করো না। কারন তুমি যে আজ অর্থ উপার্জন করছো তার পিছনে সাধারন মানুষেরই শ্রম বিদ্যমান থাকে।

পেঁচা দিবান্ধ। এখানে দার্শনিকগন আমাদের সংকেত দিয়ে গেছেন অর্থর মোহে পড়ে গেলে মানুষ কর্তব্য কর্মা-কর্মে অন্ধ হয়ে যায়। দিনে অন্ধ মানে জ্ঞানে সজাগ না থেকে অজ্ঞানের অন্ধকারে পরে যায়।

এই হলো লক্ষ্মী প্রতীমার দার্শনিক ব্যাখ্যা। এবার পূজার দার্শনিক ব্যাখ্যায় আসা যাক। পূজা শব্দের অর্থ হলো আন্তরিকভাবে সেই বিগ্রহকে উপলব্ধি করে, আন্তরিক শ্রদ্ধার সাথে জীবের সেবার জন্য বিভিন্ন দ্রব্যাদি দান করা।

অর্থাৎ পূজা তখনি সফল হবে যখন লক্ষ্মী বিগ্রহর দার্শিনিক ব্যাখ্যাকে উপলব্ধি করে তাঁকে হৃদয়ে ধারন করে ওমনি ভাবে জীবন গড়ার শপথ নেওয়া এবং এমনি জীবনের সন্ধানের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।

 এই পূজার সার্থকতা আসে তখনি যখন আমরা জানতে পারি লক্ষ্মী দেবী ঐ বিগ্রহে নেই, ঐ বিগ্রহ আমাদের শিক্ষা দেবার জন্য প্রতীক, প্রকৃত লক্ষ্মী দেবী প্রত্যেক জীবের মধ্যে বিরাজিত। তাই প্রত্যক্ষ লক্ষ্মীকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে জীবের সেবা করতে হবে। সেই জীব সেবার দিকে লক্ষ্য রেখেই পূজোয় বিভিন্ন দ্রব্য দান করতে হয়, পরে যা জীবের সেবায় ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে একটি কথা স্মরন রাখতে হবে যে, বিগ্রহে স্বয়ং লক্ষ্মী নেই ঠিকই, কিন্তু যে বিগ্রহ আমাদেরকে এত বড় শিক্ষা দিলো এবং যার মাধ্যমে প্রকৃত লক্ষ্মীর স্বরূপকে উপলব্ধি করলাম তাঁকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করতে হবে। তাই বিগ্রহে স্বয়ং লক্ষ্মী উপস্থিত না থাকলেও তাঁর প্রতীকী মনে করে অবশ্যই সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। অতএব আমরা বলতে পারি যে, পূজা তখনি সফল হবে যখন আমরা বিগ্রহকে ও মানুষকে একই সাথে সমান শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতে পারবো।

Wednesday, October 19, 2016

চলো বেদান্তের পথে...

সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টা বিরাজিত উপনিষদের এই ভাষ্যই হিন্দু ধর্মের মূল কথা । সুতরাং সেই দৃষ্টিতে বেদান্তের তত্ত্বমসি বা তুমিই পরমব্রহ্ম কিংবা অহং ব্রহ্মাষ্মি বা আমিই সেই ব্রহ্ম সত্য । এই অনুভূতিই সর্ব শ্রেষ্ঠ সাধন। এই অনুভূতি লাভ হলে তার আর কিছু করবার প্রয়োজন নেই । কিন্তু এই অনুভূতি কেন আমরা সব সময ধরে রাখতে পারি না, এই  অনুভবের পথে বাঁধা কোথায় ?

বাধা জীবত্ব দশায় । জীবত্ব হলো আমরা যখন আত্মারূপী পরমাত্মাকে কেন্দ্র করে ত্রিগুনা প্রকৃতির মাধ্যমে দেহ ও মন ধারন করি, তখন ত্রিগুন দেহ ও মনকে ব্যবহার করে জগতকে ভোগ করতে নিজ স্বরূপ ব্রহ্ম সত্ত্বাকে ভুলে যায় । এই ব্রহ্ম সত্ত্বাকে ভুলে যাওয়ার নামই অবিদ্যা । সুতরাং যখন  নিজ ব্রহ্ম সত্ত্বা ভুলে বা অবিদ্যায় আকৃষ্ট হয়ে শুধু মাত্র জগৎ ভোগে আমরা আসক্ত হয়ে পরি তখন আমি সাধারন জীবে পরিণত হই। অতএব অবিদ্যায় আমাদেরকে স্বীয় ব্রহ্ম দশা থেকে জীব ভাবে নিয়ে যায় ।

জীব দশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বীয় স্বরূপে বা ব্রহ্মভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই আমাদের সাধনা।তবে এর জন্য জগৎ সংসার ছেড়ে যেতে হবে তা ঠিক নয় । কারন এই জগৎ-সংসারের মাঝেই তো তিনি বিদ্যমান। সুতরাং তিনি যেখানে আছেন সেখানেই তো তাঁকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রকৃত পক্ষে তিনিই তো আমি । অতএব বেদান্তের অহং ব্রহ্মাষ্মি এবং শ্রী গীতার সর্ব ভূতে হীতে রতা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারন সর্ব ভূতের মাঝেই তো তিনি বিদ্যমান।

সুতরাং পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, আমরা যে জীব দশা প্রাপ্ত হয়েছি তা আমাদের প্রকৃত দশা নহে , ব্রহ্মভাবই আমাদের প্রকৃত অবস্থা । তবে এই জীব দশা থেকে মুক্ত হওয়ার নামই সাধনা।



সাধনা -

জীবন ধারন কিংবা সাধনা কোন ক্ষেত্রেই ভোগকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা ভোগকে অস্বীকার করলে নিজের অস্তিত্ব থাকে না। তাই ভোগের ক্ষেত্রে আমাদের মান্যতা ঈশ উপনিষদের সেই মহাবাক্য ভোগ ও ত্যাগের সমন্বয় সাধন। সুতরাং ভোগ নিষিদ্ধ নহে তবে ভোগে সংযমী হতে হবে।

সাধনার ক্ষেত্রে জ্ঞান,কর্ম ও ভক্তির প্রয়োজন। অর্থাৎ তত্ত্ব কে সংশয় শূন্য করতে জ্ঞান প্রয়োজন,সেই তত্ত্বকে পূর্ণরূপ দিতে কর্মের আবশ্যকতা, এবং বিশুদ্ধভাবে অন্তহীন অনুপ্রেরনায় কর্ম সমাধা করতে ভক্তির প্রয়োজন । এই তিনটিকে যোগ সাধনার দ্বারাই একত্রিত করা সম্ভব।

কিন্তু এই যোগ চিত্ত বৃত্তির নিরোধ নহে, চিত্তবৃত্তিকে রূপান্তরিত করা। কেননা যতদিন দেহ ও মন আছে ততো দিন বৃত্তি মুছে ফেলা অসম্ভব । কিন্তু সাধনাও করা প্রয়োজন । তাই চিত্ত বৃত্তির দিব্য রূপান্তর করাই এর সমাধান ।

অতএব পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ভোগে সংযমী হয়ে চিত্ত বৃত্তির দিব্য রূপান্তর ঘটাতে পারলেই নিজের ব্রহ্ম ভাব পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব ।
ওম

Tuesday, October 18, 2016

বেদ হিন্দুর মূল ধর্ম গ্রন্থ

বেদই হিন্দুর মূল ধর্ম গ্রন্থ । কীভাবে বেদ হিন্দুদের মূল ধর্ম  গ্রন্থ তা এখন জানা যাক ।

প্রকৃত পক্ষে হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠিতই আমাদের শ্রদ্ধেয় মহানুভব মনি-ঋষিদের অনুভবের উপর। আর তাঁদের অনুভবের অভিব্যক্তি হলো বেদ। যখন লিখন পদ্ধতিও আবিষ্কার হয় নাই,তখন থেকেই মনি-ঋষিগন মুখে মুখে তাঁরা তাঁদের অনুভবের অভিজ্ঞতাকে শিষ্য পরম্পরায় দিয়ে গেছেন। তখন গুরুর কাছ থেকে শিষ্য শ্রবন করে সেই শিষ্য আবার তাঁর শিষ্যকে বলে গেছেন এবং এই ভাবে বেদ প্রথমে শ্রুত হয়ে বিস্তার লাভ করেন। তাই বেদের অপর নাম হলো শ্রুতি ।

পৃথিবীর ইতিহাসে সব চেয়ে পুরানো গ্রন্থ ঋগবেদকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তবে দেখবো যে, আমাদের মনি-ঋষিগন সর্ব প্রথম প্রকৃতিকে অনুভব করেছেন। ঝড়-ঝঞ্জা, রোদ-বৃষ্টি, আলো- রাতের অন্ধকার, গ্রহ-ণক্ষত্র, গাছ-পালা, লতা-পাতা, নদী-নালা, কীট-পতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, পশু, মানুষ সমস্ত প্রকৃতিকে । এই প্রকৃতির শক্তিকে তাঁরা দেবতা রূপে শ্রদ্ধা করতেন। কেনই বা করবেন না,  এ গুলোই তো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃতি ছাড়া জীবন অসম্ভব । প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা ভরে জানাতেই দেবতার উদ্ভব । প্রকৃত পক্ষে তখন কল্পিত দেবতা ছিল না, ছিল বাস্তব দেবতা।

কিন্তু মনি-ঋষিগন শুধু প্রকৃতিকে অনুভব করেই বসে থাকেন নাই। তাঁরা  আরও সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। প্রকৃতির মাঝের শক্তিকে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন। তাইতোএই ঋগবেদে ঋষিদের বলতে দেখি সবার মাঝে এক অক্ষয় চেতন শক্তি বিরাজিত, সেই হলো পরম ব্রহ্ম । সুতরাং আমরা দেখছি প্রকৃতিকে অনুভবের মাধ্যমে সেই মহানুভবগন আরও এগিয়ে পরম ব্রহ্ম কে অনুভব করেছেন। অর্থাৎ পরম ব্রহ্ম আর কোথাও নেই এই প্রকৃতির মাঝেই তিনি চেতন সত্ত্বা রূপে বিরাজিত।

সুতরাং মনি-ঋষিগন অনুভব করলেন এই প্রকৃতি ও চেতনাময় পরম ব্রহ্ম দুটোয় আমাদের উপলব্ধির বিষয় । তাই দুটো বিদ্যা রচিত হলো এক অপরা বিদ্যা এবং দ্বিতীয়টি পরা বিদ্যা। অপরা বিদ্যা হলো প্রকৃতিকে জয় করার আর পরা বিদ্যা হলো পরম ব্রহ্ম কে লাভ করার। সুতরাং বেদই হলো সেই বিশাল জ্ঞান ভান্ডার যেখানে অপরা ও পরা বিদ্যা দুটিই বিদ্যমান ।

প্রকৃতিকে জয় করার যে অপরা বিদ্যা তা বিশাল । বেদে অর্থাৎ তৈত্তিরীয় উপনিষদে পাঁচটি ভাগে অপরা বিদ্যাকে  ভাগ করা হয়েছে ।


১) অধিবিদ্যা ।

২) আধ্যাত্ম বিদ্যা ।

৩) অধিলোক বিদ্যা ।

৪) অধিজ্যোতিষ বিদ্যা ।

৫) অধিপ্রজা বিদ্যা ।

অধিবিদ্যার মূল কথা হলো ব্যাকরনাদি জানার মাধ্যমে ভাষা শিক্ষা অর্জন করা, এবং তার সঠিক ব্যবহার করা ।এই ভাষার মাধ্যমেই আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করে সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি। তাই ভাষা শিক্ষা আমাদের জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ।

আধ্যাত্ম বিদ্যা হলো দেহ বিষয়ক বিদ্যা । সুতরাং দেহ ধারন ও তার রক্ষনের জন্য যে কর্ম মুখী বিদ্যা তাই আধ্যাত্ম বিদ্যা । যেমন ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং সহ বিভিন্ন কর্ম মুখী বিদ্যা ।

অধিলোক বিদ্যা হলো বর্তমানে আমরা যে জগতে বাস করছি সেই জগৎ এবং মৃত্যুর পরের জগৎ সর্স্পকে যে জ্ঞান লাভ হয় তাই অধিলোক বিদ্যা ।

গ্রহ-ণক্ষত্র সর্ম্পকে যে বিদ্যা তাই অধিজ্যোতিষ বিদ্যা । নভোচারিরা এই বিদ্যার মাধ্যমেই গ্রহ ও ণক্ষত্রের অনেক অজানা তথ্য আমাদেরকে দান করছেন এবং জ্যোতিষগন গ্রহ-ণক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আমাদের জীবনের ভুত-ভবিষ্যতও জানিয়ে দিচ্ছেন ।

আর সর্বশেষ বিদ্যা হলো অধিপ্রজা বিদ্যা । নিজের সন্তা-সন্তুতির জন্ম দান করা থেকে শুরু করে, তাদেরকে প্রকৃত মানুষ করা এ্ই বিদ্যার অন্তর গত। এই বিদ্যার প্রভাবেই মানুষ মানুষের সাথে সর্ম্পক কীভাবে গড়বে তা নির্ণয় করে থাকে ।

এ সমস্ত হলো অপরা বিদ্যা আর পরা বিদ্যা হলো  উপনিষদ জাতীয় গ্রন্থ যেখানে আত্মার  স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে । তবে আত্মার অনুভুতিই হলো প্রকৃত পরা বিদ্যা । সেই কারনে অনেকে বলে থাকেন লিখিত সমস্ত  বিদ্যাই অপরাবিদ্যা, শুধুমাত্র আত্মার অনুভবই পরা বিদ্যা ।

অপরা বিদ্যাকে প্রেয় বা প্রিয় বিদ্যা বলা হয় । কেন ? কারন অপরা বিদ্যা বর্তমান অস্তিতবান দেহের উপকারে আসে এবং আমরা তার দৃশ্যমান সুফল পাই । কিন্তু পরা বিদ্যা আত্ম বিষয়ক বিদ্যা যার দ্বারা দৈহিক কোন উপকার পাওয়া যায় না, জন্য এটি অনেকটা কম প্রিয় । তবে শাস্ত্র একে শ্রেয় বলেছেন । কেননা, দেহের সমাপ্তি হলে সর্বশেষে আমাদের আত্মাতেই পরম গতি লাভ হয় । তাই পরা বিদ্যা শ্রেষ্ট বিদ্যা ।

মুন্ডক উপনিষদে অঙ্গিরস ঋষি গৃহস্থ শৌনক কে বলেছিলেন হে শৌনক যদি তুমি পরম গতি লাভ করতে চাও তবে পরা ও অপরা এই দুটি বিদ্যাই তোমাকে অর্জন করতে হবে  আর বেদ এই দুটি বিদ্যা নিয়েই আলোচনা করেছেন ।

এই বেদ থেকে গবেষনা করে আমাদের জীবন-যাপনের জন্য বিধান গ্রন্থ মনু, পরশর, ব্যাস বিভিন্ন সংহিতা গ্রন্থ রচিত হয়েছে । এদের মধ্যে মনু সংহিতা হিন্দুদের প্রধান বিধান মালা যেখানে আমাদের সমাজনীতি, রাজনীতি, কুটনীতি থেকে শুরু করে সমস্ত ইহ জাগতিক জীবন প্রনালীর প্রক্রিয়া বর্ণিত আছে । আমাদের ভুললে চলবে না এদের মূল ভিত্তি বেদ ।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বেদ একটি এমন গ্রন্থ যেখানে ইহজগৎ ও পরজগতের সমস্ত সমাধান রয়েছে । হিন্দুধর্মে এ রকম আর দ্বিতীয়টি কোন গ্রন্থ নেই যা বেদের সাথে তুলনীয় । অতএব বেদই হলো হিন্দুদের মূল ধর্ম গ্রন্থ ।

ওম

Sunday, October 16, 2016

হিন্দু ধর্মের ইতিহাস

কোন নির্দীষ্ট সালে কোন ব্যক্তির দ্বারা হিন্দু ধর্ম প্রচারিত নহে। এ ধর্ম সৃষ্টি থেকে বিদ্যমান।

আমাদের পূর্ব পুরুষগন প্রকৃতির মধ্যে বাস করতে করতে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে প্রথমে দেবতা রূপে এবং অবশেষে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি যাকে দেব-দেবী রূপে শ্রদ্ধা করতেন  তিনি যে এক ও অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম তা তাঁরা পরে অনুভব করেন। সুতরাং হিন্দুধর্ম কোন মতবাদ থেকে উৎপত্তি নয় অনুভব থেকে সৃষ্টি।

হিন্দুধর্মর ক্রমবিকাশে আমরা বলতে পারি প্রথমে দৃশ্যমান প্রকৃতিকে অনুভব করে পরে অদৃশ্য শক্তি পরমব্রহ্মকে অনুভব করা। প্রথম কোন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে এমনি হয়। প্রথমে দৃশ্যমান বিষয়-বস্তু থেকে খোঁজ শুরু হয় এবং অবশেষে সুক্ষ্ম সর্বশেষ বস্তুতে পৌছে তার সমাপ্তি হয়।

আমাদের অগ্রজ শ্রদ্ধেয় মনি-রিষিগন তাঁদের সমস্ত জীবন দিয়ে  আমাদের  আশ্রয়স্থল প্রকৃতি ও পরমব্রহ্মকে অনুভব করে গেছেন। তাঁরা  অনুভব করে গেছেন, আমাদেরএই দৃশ্যমান শরীর এই দৃশ্যমান প্রকৃতিরই দান।  আমাদের এই শরীরের অস্তিত্ব প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তাই শরীর রক্ষার্থ এ প্রকৃতির নিয়মই হিন্দুর বিধান।

আবার অপর পক্ষে সুক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন ও নির্বীকার  এবং নিরপেক্ষ মনি-রিষিগন নিজের শরীরের মাধ্যমে গবেষনা করতে করতে বুঝলেন যে, প্রকৃতির দান স্থুল এই শরীরের মধ্যেই নির্বীকার, নিরাকার, অবিনশ্বর এক চেতন সত্ত্বা আছে। বিজ্ঞ মনি-রিষিগন একেই নাম দিলেন আত্মা বা ব্রহ্ম। এই আত্মাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতির মাধ্যমে দেহ নির্মান হয়ে থাকে। তাঁরা আরও উপলব্ধি করলেন যে, এই আত্মীক চেতনাতেই আমাদের দেহ চেতনাবান। আত্মার উপর ভিত্তি করেই আমাদের দেহ অস্তিত্ববান।

অতএব হিন্দুধর্ম এ দুটি তত্ত্ব জানা গেল, এক হলো আত্মা এবং দ্বিতীয় হলো প্রকৃতি।  এই আত্মা হলো সুক্ষ্ম, অবিনশ্বর , চেতন সত্ত্বা আর প্রকৃতি হলো দৃশ্যমান স্থুল নশ্বর সত্ত্বা। এই আত্মাকে পুরুষ ও প্রকৃতিকে ধরে হিন্দু দর্শনে উদ্ভব হলো পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্ব। সকল দর্শনেই পুরুষ প্রকৃতি তত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে তবে বিচারে কিছুটা তফাৎ আছে।

এই পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই হিন্দু ধর্ম সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এই পুরুষ বা আত্মা স্বয়ং পরম ব্রহ্ম আর প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টি। এখান থেকেই এসেছে প্যানথিইজম। অর্থাৎ সকল সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টা আত্মা রূপে বিরাজিত। এখান থেকেই এসেছে সাম্যবাদ, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সবাই সমান। কারন সবার মাঝে একই ঈশ্বর বিরাজিত। একে সর্বশ্বরবাদও বলা হয়।

তবে অনেক দর্শন প্রত্যেক জীবের ভীতর বিদ্যমান আত্মাকে ভিন্ন ভিন্ন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু বেদান্ত তা খন্ডন করেছেন যথেষ্ট যুক্তির মাধ্যমে। অর্থাৎ সকল আত্মাই গুনগত ভাবে এক। সুতরাং বেদান্ত মনে করেন , নির্বিকার, নিরাকার, এক বিশাল আত্মা সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজিত। অর্থাৎ বিশাল আত্মাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতি দৃশ্যমান হয়। আবার প্রকৃতি যেহেতু দৃশ্যমান তাই এটি মিশ্র। মিশ্র বস্তুর উপাদানের মধ্যে কম-বেশী হলে তা ধ্বংস হযে যায়। তাই মৃত্যু হলে আত্মা দেহ থেকে বের হয়ে যায় না প্রকৃতিই আত্মা থেকে খসে পরে। আত্মা সর্বদা তার চেতন সত্ত্বা নিয়ে সতত্ বিদ্যমান।

 অতএব এই দেহ ও আত্মা থেকে হিন্দু ধর্মে সর্বশেষ তত্ত্ব এলো মুক্তি বা মোক্ষ। অর্থাৎ দেহ হলো প্রকৃতজাত বিকারযুক্ত স্থুল বস্তু যা আমার প্রকৃত স্বরূপ নির্বিকার, নিরাকার আত্ম সত্ত্বাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট্। আর এই সৃষ্টির কারন হলো প্রকৃতির সুখ ও দুঃখ ভোগ করা। অর্থাৎ প্রকৃতি আত্মায় ভর করে জগতের সুখ ও দুঃখ ভোগ করে। সুতরাং সুখ ও দুঃখ দেহের আত্মার নয়। তাই সুখ ও দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন নিজ নির্বিকার, নিরাকার আত্ম সত্ত্বায় ফেরা্। অতএব সকল ভোগ বাসনা থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলে, নিজের আত্ম সত্ত্বায় ফেরা যায়। কারন মনের অভ্যন্তরে ভোগ বাসনার কামনা থেকেই আসে দেহ ধারন। তাই ভোগ বাসনা থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলেই দেহ ধারন বন্ধ হয় এবং নিজ আত্ম স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, যাকে মুক্তি বা মোক্ষ বলে। সুতরাং নিজ আত্ম সত্ত্বায় থাকার নামই মুক্তি। এই আত্ম সত্ত্বায় ব্রহ্ম। তাই মুক্তিকে ব্রহ্ম প্রাপ্তি বলা হয়। তবে এই ব্রহ্ম সত্ত্বা শুধুমাত্র চেতন একটি পদার্থ নয়, ইনি জ্ঞানময় ও সর্বশক্তিমান এক চেতন সত্ত্বা যাকে  কেন্দ্র করে এবং যার শক্তিতেই সমস্ত কিছু সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ হয়ে থাকে।
ওম

Friday, October 14, 2016

হিন্দুত্ববাদ কী এর উৎপত্তি এবং প্রয়োজনীয়তা

প্রথমে জানা প্রয়োজন হিন্দুত্ববাদ কী?

সমগ্র হিন্দুজাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও তার বিকাশের যে মতবাদ তাই হিন্দুত্ববাদ। অর্থাৎ এই জাতির অস্তিত্ব রক্ষা এবং তার বিকাশের জন্য যে যে কর্ম করা প্রয়োজন সেই কর্ম প্রক্রিয়ার যে গাইড লাইন তাই হিন্দুত্ববাদ।

হিন্দুত্ববাদের বিষয় দুটি-

১) আমাদের বাহ্যিক আচার-আচরন, শিল্প, সাহিত্য ও সংষ্কৃতি। খুব সংক্ষেপে আমাদের হিন্দুদের সমাজ ব্যবস্থা।

২) আধ্যাত্মিক দর্শন।

হিন্দুর সমাজব্যবস্থা


হিন্দু ধর্ম বাইরে থেকে আগত কোন ধর্ম নয়। এ ধর্ম সৃষ্টির সাথে সাথে এই ভারতীয়  উপমহাদেশেই উৎপত্তি লাভ করে। পরে ভারতীয় মনি-ঋষিদের বিশুদ্ধ ও গভীর  চিন্তা-চেতনার ফসল বেদের মাধ্যমে তা বিস্তার লাভ করে সুসংগঠিত একটি ধর্মর রূপ নেয়, যা  আজ সনাতন বা হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত।
যেহেতু হিন্দুধর্ম এই দেশেই উৎপত্তি এবং আমরাও হিন্দুরা এই দেশেরই বাসিন্দা তাই হিন্দুর শিল্প, সাহিত্য, সংষ্কৃতি, আচার-আচরন, সমাজ ব্যবস্থা সমস্ত কিছু আমাদের নিজস্ব ভারতীয়। এ সমস্ত কিছু আমাদের ডিএনএ তে এবং রক্তের সাথে মিশে আছে। এগুলি  আমাদের  নিজস্ব  এবং  এই গুলিই   আমাদের  জীবন। এই  আমাদের  নিজস্ব ভারতীয় সংষ্কৃতির  মাধ্যমে হিন্দুধর্ম টিকে  থাকে। তাই  হিন্দুধর্মকে টিকে  রাখতে  চাইলে  সবার আগে সংষ্কৃতির  ধারক হিন্দুকে  হতেই হবে।
আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যা-খাদ্য, বিভিন্ন উৎসব, দশ বিধি সংষ্কার এই সমস্ত কিছুর মাধ্যমেই হিন্দুদের সংষ্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ সমস্ত কিছু বেদের কর্ম কান্ডে বর্ণীত আছে। অর্থাৎ বেদের কর্ম কান্ড অনুযায়ীই হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে তাদের সংষ্কৃতি পালন করে আসছে। এই সকল সংষ্কৃতিই যখন অতি শ্রদ্ধার সাথে পালন করা হয় তখন তাই ধর্ম হয়ে যায়।


হিন্দুর আধ্যাত্মিক দর্শন

হিন্দুর আধ্যাত্মিক দর্শন অতি উচ্চ।  আমরা উপনিষদ থেকেএই সুউচ্চ বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে পারি। উপনিষদের মূল সুরই হলো পরমব্রহ্ম  আত্মারূপে সর্বত্র বিরাজিত। অর্থাৎ উপনিষদই প্রথম ও শেষ গ্রন্থ যেটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে সকল জীবকেই ঈশ্বর রূপে ঘোষনা করেছেন। পরিষ্কারভাবে বলতে হয় আমরা এই জগতে যে জীব দেখছি এ প্রকৃত পক্ষে ব্রহ্মই। ব্রহ্মই সমস্ত কিছু হয়েছেন। অর্থাৎ ব্রহ্ম স্বয়ং এই জগৎ এবং জীবরূপে তিনি নিজেকে বিকশিত করেছেন। তাই নিজেকে সমস্ত কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত করে ঈশ্বরের মতো পবিত্র বা বিশুদ্ধ করে সদা সর্বদা আত্ম সত্ত্বায় স্থির থাকো্। তোমার মধ্যে যেমন আত্মারূপী ব্রহ্ম আছেন অপর সকল জীবের মধ্যেও সেই একই আত্মারূপী ব্রহ্ম বিরাজিত। তাই জীবের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা হয়ে থাকে। অতএব উপনিষদের বানী হলো নিজেকে বিশুদ্ধ ঈশ্বরীয় আত্ম সত্ত্বায় স্থির রেখে নিজের সহ সকলের মঙ্গল সাধনায় ঈশ্বরীয় কর্ম মনে করে ইহজাগতিক প্রয়োজনীয় কর্ম সম্পাদন করো।
যদি শুধু নিজের মঙ্গল কামনায় ভোগের আসক্তি নিয়ে কর্ম করো তবে সেই  আসক্তির ফল ভোগ করার জন্য পুনঃ জন্ম নিয়ে আবার পৃথিবীতে তোমাকে আসাতে হবে। এই হলো জন্মান্তরবাদ এবং জীবের আবদ্ধতা। আর নিজের ভোগ-বাসনার নিমিত্তে নয়, ঈশ্বরীয় কর্ম মনে করে নিজের ভোগ-বাসনায় মত্ত না হয়ে জীবের সেবায় কর্ম করলে মুক্তি লাভ হয়। অর্থাৎ তার আর পুনঃ জন্ম হয় না।


হিন্দুত্ববাদের উৎপত্তি

হিন্দুধর্ম এর উৎপত্তির সময় হিন্দুত্ববাদের উদ্ভব হয় নাই। কারন তখন দ্বীতিয় কোন ধর্মই ছিল না। তাই হিন্দুত্ববাদের প্রয়োজন হয় নাই।
এছাড়াও হিন্দুর আধ্যাত্মিক মতবাদে কোন বিশেষ শ্রেনীর মানুষকে স্বর্গীয় মানুষ রূপে বিবেচনা করা হয় নাই। হিন্দুর আধ্যাত্মিক মত হলো সকল জীবের মধ্যেই পরম ব্রহ্ম বিরাজিত। আরও পরিষ্কার কথা ব্রহ্মই সমস্ত কিছু হয়েছেন। তাই হিন্দুরা অন্য জাতির মানুষকে ব্রহ্ম ভিন্ন অন্যরূপে দেখেন না। তাই হিন্দুর আধ্যাত্মিক দর্শন অনুযায়ী হিন্দুত্ববাদের এখনও প্রয়োজন নেই।
কিন্তু ম্যান মেড ধর্ম মত গুলো যখন নিজের অনুসারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বেপড়োয়া হয়ে উঠলো এবং হিন্দুর সংষ্কৃতি ও আধ্যাত্মিক দর্শনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়ে আমাদের ধর্মকে ধ্বংস করতে লাগলো তখনি দেখা দিল হিন্দুত্ববাদ। যেহেতু নিজেকে রক্ষা করা এবং নিজের উন্নতি সাধনের অধিকার সবার আছে সেই অধিকারের আইন মাথায় রেখেই হিন্দুত্ববাদের জন্ম হলো।

তবে একটি কথা পরিষ্কার করে বলি, হিন্দুত্ববাদ মানে অপর কোন ধর্মকে  আঘাত করা নয়, বরং হিন্দুরা সকল ধর্মকে সমান ভাবে শ্রদ্ধা করে। তবে যেহেতু বহুদিন ধরে হিন্দুধর্ম নিজের অস্তিত্ব রক্ষার হুমকিতে পরেছে তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্যই হিন্দুত্ববাদের জন্ম।


হিন্দুত্ববাদের প্রয়োজনীয়তা

যুগের চাহিদা অনুযায়ী হিন্দুধর্ম এ এখন হিন্দুত্ববাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কারন আমাদের অনেক ছেলে-মেয়েরাই হিন্দুধর্মকে সঠিকভাবে না জানার জন্য আজ ধর্মান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি প্রত্যেক হিন্দুকে বিশেষ করে যারা পিতা-মাতা হয়েছেন তাদেরকে  আহ্বান করবো  আপনারা নিজেরাও হিন্দু সংষ্কৃতি ও আধ্যাত্মিক দর্শনকে বুঝুনএবংমানুন ও আপনাদের সন্তান-সন্তুতিদেরকে হিন্দু ধর্ম মতকে শিক্ষা দিন। এটিই হিন্দুত্ববাদ। এটি আপনাকে ধ্বংস করবে না, বরং এটি আপনার ধর্ম ও সম্মান উভয়ী রক্ষা করবে।

Monday, October 3, 2016