Wednesday, November 23, 2016

ধর্ম, অর্থ,কাম ও মোক্ষ

মানব জীবনে চারটি বিষয় অতি জরুরী, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। আসুন আমরা সবাই এই্ চারটি বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ভাবে বোঝার চেষ্টা করি।

ধর্ম:

ধর্ম শব্দের অর্থ যা মানুষকে ধারন করে। প্রশ্ন কে আমাদেরকে ধারন করে আছেন? উত্তর আত্মা আমাদেরকে ধারন করে আছেন। কারন আত্মা থাকলে আমরা জীবিত থাকি আর আত্মা না থাকলে আমরা মৃত্যু বরণ করি। সুতরাং সেই ভিত্তি সত্ত্বা আত্মাকে জানাই আমাদের প্রধান কাজ।

তাঁকে তো জানবো কিন্তু তিনি থাকেন কোথায় ? বেদ বলছেন তিনি প্রত্যেক জীবের হৃদয়ে আবস্থান করেন । তাহলে তাঁকে পেতে গেলে আমাদেরকে মনের অভ্যন্তরে যেতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মন সহ সকল ইন্দ্রিয়গন সর্বদা বর্হিমুখী। তাই বর্হিমুখী সকল ইন্দ্রিয়কে অন্তরমুখী করতে বেদ কিছু প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন যাকে সাধনা বলা হয়। এই সাধনার দ্বারাই মানুষ তাঁর মধ্যে বসবাসরত আত্মাকে লাভ করতে পারবেন, যা ব্রহ্ম স্বয়ং। অতএব স্বীয় সত্ত্বাকে লাভ করবার জন্য বেদের যে বিভিন্ন ব্যবস্থা বা বিধান তাই ধর্ম।

অর্থ:

অর্থ মানব জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থাৎ যতদিন আমাদের দেহের অস্তিত্ব আছে এবং সেই দেহকে নিয়ে এই জগতে বাস করতে হবে ততোদিন অর্থ লাগবেই , এমনকি আমরা বলতে পারি অর্থ ছাড়া জীবনকে কল্পনাও করা যায় না।

কিন্তু আমাদের একটা ভুল ধারনা আছে যে অর্থ আমাদের আধ্যাত্মিক পথের বাঁধা। এটি সম্পুর্ণ ভুল ধারনা। কেননা তাই যদি প্রকৃতির নিয়ম হতো তাহলে অর্থের প্রতি আমাদের এতো গুরুত্ব কোন ভাবেই হতো না। এছাড়াও কিছু উদাহরনকে চিন্তন করুন যেমন - ভগবান শ্রীরাম, শ্রী কৃষ্ণ সবাই রাজার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন এবং নিজেরাও রাজা ছিলেন। আবার ধর্ম রাজ যা পৃথিবীতে শুধু একজন সেই যুধিষ্ঠিরও সম্রাট ছিলেন। সুতরাং অর্থ আধ্যাত্মিক পথের বাধা নয় । তবে একটি বিষয় সর্বাদ মনে রাখতে হবে, আমার উপার্জিত অর্থ যেন সৎ পথের হয় এবং ব্যয়ও সৎ পথে হয়। তাহলে সেই অর্থ আপনাকে আনন্দ দেবে নয়তো বা তা পিড়া দেবে।

এছাড়াও অর্থ ব্যাপারে আমাদেরকে একটু সাবধান থাকতে হবে যে, আমরা অর্থের মালিক, অর্থ যেন আমাদের মালিক না হয়, তাহলে অর্থে অহংকার এসে যায় ও তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পরে।

কাম:

কামনাকে পূর্ণ করার জন্যই এই পৃথিবীতে আমার, আপনার সবার জন্ম। তাছাড়া কেন আমাদের জন্ম হবে বলুন? স্বীয় ভোগবাদী দৃষ্টিতে নিজের কামনা পূর্ন করলেও আধ্যাত্মিক পথেও আমরা সবাই ঈশ্বরের কামনাই পূর্ণ করছি। সেই জন্যই তো তিনি আমাদের সবাইকে বিশেষ বিশেষ গুন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে করে আমরা তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ করি। মনে রাখতে হবে, যা নিজের ও সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর সেই কামনা পূর্ণ করাই আমাদের কর্তব্য। অতএব গুন অনুসারে কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করার নামই কাম এবং এই কাম পূর্ণ করার জন্যই ভগবানের এই বিশাল সৃষ্টির রচনা করা। তাই কামপূর্ণ করা মানব জন্মের প্রধান কারন।

মোক্ষ:

আমাদের যে স্বীয় সত্ত্বা আত্মা, সেই আত্মাই পরমব্রহ্ম। সেই নির্বিকার, নিরাকার পরমব্রহ্মকে লাভ করাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। যখন এই জীবিত অবস্থায় আমরা নিজের নির্বিকার স্বরূপকে গ্রহন করতে পারবো এবং নির্বিকার থেকে জীবন-যাপন এর কর্ম সম্পাদন করতে পারবো তখনি আমাদের মোক্ষ প্রাপ্তি হবে।


Wednesday, November 2, 2016

বৈদিক দেবতা, পরমব্রহ্ম ও মুর্তিপূজা

হিন্দু ধর্ম অনুভবের উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদের উপর নয়। বৈদিক রিষিগন প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন শক্তিকে প্রথম অনুভব করেন এবং সেই ভিন্ন ভিন্ন শক্তিকে তাঁরা বিভিন্ন দেবতা রূপে উপাসনা করতে লাগেন। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিই বৈদিক যুগের বিভিন্ন দেবতা।

তারপর প্রকৃতির উপর তাঁদের গবেষনা আরও সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং তাঁরা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির মধ্যে এক মহান শক্তিকে অনুভব করলেন। অর্থাৎ প্রকৃতির যে বিভিন্ন শক্তি প্রকৃত পক্ষে এগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভিন্ন কিন্তু অভ্যন্তরীন ভাবে এক মহান শক্তিরই অংশ। এই প্রকৃতির মাঝে বা সৃষ্টির মাঝে যে মহান শক্তি ক্রিয়া করছে সেই সামগ্রীক মহান শক্তিই পরম ব্রহ্ম।

যখন সৃষ্টির সামগ্রীক শক্তিই যে পরম ব্রহ্ম সুনিশ্চিত হলো মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণ বিকাশ ঘটলো। মানুষ এবার প্রত্যক্ষ দর্শন ও অনুভূতির পর জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করলো। সৃষ্টির সকল বিষয়কে জ্ঞানের দ্বারা ব্যাখ্যা করা শুরু হলো। অর্থাৎ এই সৃষ্টিতে মানুষ যা দেখছে ও অনুভব করছে তাঁর কারন ও কার্য্য খোঁজ করতে শুরু করলো। আধ্যাত্মিকতা দর্শনের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে লাগলো। এই আধ্যাত্মিকতা যখন দর্শনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা শুরু হলো তখন এলো মূর্তি পূজা।

মূর্তিপূজার দার্শনিক ব্যাখ্যা এলো এই ভাবে যে, এই সৃষ্টির সামগ্রীক শক্তি যে পরম ব্রহ্ম আসলে তাঁর সামগ্রীকতার মধ্যে কী কী খন্ড শক্তি লুকায়িত আছে। পরম ব্রহ্মের এই সামগ্রীক সত্ত্বার যে খন্ড শক্তি সেই শক্তিকে বুঝানোর জন্য প্রতীকি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলো মূর্তি, আর তাঁর সেই সত্ত্বাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনই হলো পূজা। সুতরাং ঈশ্বরীয় কোন বিশেষ সত্ত্বাকে অনুভব করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর নামই মূর্তি পূজা।

উদাহরন স্বরূপ আমরা শ্রী লক্ষ্মী দেবীকে ধরে নিতে পারি। প্রথমে আমরা লক্ষ্মী দেবীর মূর্তিকে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করি এবং তারপর তাঁর পূজার বিষয়ে জানবো।

লক্ষ্মী দেবী এক নারী বিগ্রহ, তাঁর দুটো হাত এবং তাঁর এক হাতে অর্থের প্রতীক ধান্য এবং অপর হাতে সৃষ্টির প্রতীক পদ্ম। তাঁর বাহন পেঁচা যে দিনে  অন্ধ। আমরা এর দার্শনিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।

নারী বিগ্রহের মাধ্যমে আমাদের পূর্ব পুরুষ দার্শনিকগন বুঝাতে চেয়েছেন,অর্থ সব সময় তোমার অধীনে থাকবে। অর্থাৎ সংসারে নারী যেমন পুরুষের আয়ত্তে থাকে ধ্বন সম্পদও সর্বদা তোমার আয়ত্তে থাকবে। কিন্তু তুমি যদি অর্থের আয়ত্তে চলে যাও তবে অর্থ লিপ্সু হয়ে যাবে এবং প্রকৃত মানুষ আর থাকবে না।

তিনি ধ্বন-সম্পদ বা অর্থের দেবী তাই তাঁর এক হাতে অর্থের প্রতীক ধান্য। অপর হাতে পদ্ম যা সৃষ্টির প্রতীক। অর্থাৎ কোন কিছু সমাজে সৃষ্টি করতে অর্থ প্রয়োজন।

একটি পশু তাঁর বাহন। অর্থাৎ অর্থের অহংকারে কাউকো তুচ্ছ চিন্তন করে অপরের সাথে অসৎ আচরন করো না। কারন তুমি যে আজ অর্থ উপার্জন করছো তার পিছনে সাধারন মানুষেরই শ্রম বিদ্যমান থাকে।

পেঁচা দিবান্ধ। এখানে দার্শনিকগন আমাদের সংকেত দিয়ে গেছেন অর্থর মোহে পড়ে গেলে মানুষ কর্তব্য কর্মা-কর্মে অন্ধ হয়ে যায়। দিনে অন্ধ মানে জ্ঞানে সজাগ না থেকে অজ্ঞানের অন্ধকারে পরে যায়।

এই হলো লক্ষ্মী প্রতীমার দার্শনিক ব্যাখ্যা। এবার পূজার দার্শনিক ব্যাখ্যায় আসা যাক। পূজা শব্দের অর্থ হলো আন্তরিকভাবে সেই বিগ্রহকে উপলব্ধি করে, আন্তরিক শ্রদ্ধার সাথে জীবের সেবার জন্য বিভিন্ন দ্রব্যাদি দান করা।

অর্থাৎ পূজা তখনি সফল হবে যখন লক্ষ্মী বিগ্রহর দার্শিনিক ব্যাখ্যাকে উপলব্ধি করে তাঁকে হৃদয়ে ধারন করে ওমনি ভাবে জীবন গড়ার শপথ নেওয়া এবং এমনি জীবনের সন্ধানের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার সাথে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।

 এই পূজার সার্থকতা আসে তখনি যখন আমরা জানতে পারি লক্ষ্মী দেবী ঐ বিগ্রহে নেই, ঐ বিগ্রহ আমাদের শিক্ষা দেবার জন্য প্রতীক, প্রকৃত লক্ষ্মী দেবী প্রত্যেক জীবের মধ্যে বিরাজিত। তাই প্রত্যক্ষ লক্ষ্মীকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে জীবের সেবা করতে হবে। সেই জীব সেবার দিকে লক্ষ্য রেখেই পূজোয় বিভিন্ন দ্রব্য দান করতে হয়, পরে যা জীবের সেবায় ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে একটি কথা স্মরন রাখতে হবে যে, বিগ্রহে স্বয়ং লক্ষ্মী নেই ঠিকই, কিন্তু যে বিগ্রহ আমাদেরকে এত বড় শিক্ষা দিলো এবং যার মাধ্যমে প্রকৃত লক্ষ্মীর স্বরূপকে উপলব্ধি করলাম তাঁকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করতে হবে। তাই বিগ্রহে স্বয়ং লক্ষ্মী উপস্থিত না থাকলেও তাঁর প্রতীকী মনে করে অবশ্যই সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। অতএব আমরা বলতে পারি যে, পূজা তখনি সফল হবে যখন আমরা বিগ্রহকে ও মানুষকে একই সাথে সমান শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতে পারবো।