Sunday, October 16, 2016

হিন্দু ধর্মের ইতিহাস

কোন নির্দীষ্ট সালে কোন ব্যক্তির দ্বারা হিন্দু ধর্ম প্রচারিত নহে। এ ধর্ম সৃষ্টি থেকে বিদ্যমান।

আমাদের পূর্ব পুরুষগন প্রকৃতির মধ্যে বাস করতে করতে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে প্রথমে দেবতা রূপে এবং অবশেষে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি যাকে দেব-দেবী রূপে শ্রদ্ধা করতেন  তিনি যে এক ও অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম তা তাঁরা পরে অনুভব করেন। সুতরাং হিন্দুধর্ম কোন মতবাদ থেকে উৎপত্তি নয় অনুভব থেকে সৃষ্টি।

হিন্দুধর্মর ক্রমবিকাশে আমরা বলতে পারি প্রথমে দৃশ্যমান প্রকৃতিকে অনুভব করে পরে অদৃশ্য শক্তি পরমব্রহ্মকে অনুভব করা। প্রথম কোন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে এমনি হয়। প্রথমে দৃশ্যমান বিষয়-বস্তু থেকে খোঁজ শুরু হয় এবং অবশেষে সুক্ষ্ম সর্বশেষ বস্তুতে পৌছে তার সমাপ্তি হয়।

আমাদের অগ্রজ শ্রদ্ধেয় মনি-রিষিগন তাঁদের সমস্ত জীবন দিয়ে  আমাদের  আশ্রয়স্থল প্রকৃতি ও পরমব্রহ্মকে অনুভব করে গেছেন। তাঁরা  অনুভব করে গেছেন, আমাদেরএই দৃশ্যমান শরীর এই দৃশ্যমান প্রকৃতিরই দান।  আমাদের এই শরীরের অস্তিত্ব প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তাই শরীর রক্ষার্থ এ প্রকৃতির নিয়মই হিন্দুর বিধান।

আবার অপর পক্ষে সুক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন ও নির্বীকার  এবং নিরপেক্ষ মনি-রিষিগন নিজের শরীরের মাধ্যমে গবেষনা করতে করতে বুঝলেন যে, প্রকৃতির দান স্থুল এই শরীরের মধ্যেই নির্বীকার, নিরাকার, অবিনশ্বর এক চেতন সত্ত্বা আছে। বিজ্ঞ মনি-রিষিগন একেই নাম দিলেন আত্মা বা ব্রহ্ম। এই আত্মাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতির মাধ্যমে দেহ নির্মান হয়ে থাকে। তাঁরা আরও উপলব্ধি করলেন যে, এই আত্মীক চেতনাতেই আমাদের দেহ চেতনাবান। আত্মার উপর ভিত্তি করেই আমাদের দেহ অস্তিত্ববান।

অতএব হিন্দুধর্ম এ দুটি তত্ত্ব জানা গেল, এক হলো আত্মা এবং দ্বিতীয় হলো প্রকৃতি।  এই আত্মা হলো সুক্ষ্ম, অবিনশ্বর , চেতন সত্ত্বা আর প্রকৃতি হলো দৃশ্যমান স্থুল নশ্বর সত্ত্বা। এই আত্মাকে পুরুষ ও প্রকৃতিকে ধরে হিন্দু দর্শনে উদ্ভব হলো পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্ব। সকল দর্শনেই পুরুষ প্রকৃতি তত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে তবে বিচারে কিছুটা তফাৎ আছে।

এই পুরুষ ও প্রকৃতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই হিন্দু ধর্ম সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। এই পুরুষ বা আত্মা স্বয়ং পরম ব্রহ্ম আর প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টি। এখান থেকেই এসেছে প্যানথিইজম। অর্থাৎ সকল সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টা আত্মা রূপে বিরাজিত। এখান থেকেই এসেছে সাম্যবাদ, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সবাই সমান। কারন সবার মাঝে একই ঈশ্বর বিরাজিত। একে সর্বশ্বরবাদও বলা হয়।

তবে অনেক দর্শন প্রত্যেক জীবের ভীতর বিদ্যমান আত্মাকে ভিন্ন ভিন্ন বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু বেদান্ত তা খন্ডন করেছেন যথেষ্ট যুক্তির মাধ্যমে। অর্থাৎ সকল আত্মাই গুনগত ভাবে এক। সুতরাং বেদান্ত মনে করেন , নির্বিকার, নিরাকার, এক বিশাল আত্মা সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজিত। অর্থাৎ বিশাল আত্মাকে কেন্দ্র করেই প্রকৃতি দৃশ্যমান হয়। আবার প্রকৃতি যেহেতু দৃশ্যমান তাই এটি মিশ্র। মিশ্র বস্তুর উপাদানের মধ্যে কম-বেশী হলে তা ধ্বংস হযে যায়। তাই মৃত্যু হলে আত্মা দেহ থেকে বের হয়ে যায় না প্রকৃতিই আত্মা থেকে খসে পরে। আত্মা সর্বদা তার চেতন সত্ত্বা নিয়ে সতত্ বিদ্যমান।

 অতএব এই দেহ ও আত্মা থেকে হিন্দু ধর্মে সর্বশেষ তত্ত্ব এলো মুক্তি বা মোক্ষ। অর্থাৎ দেহ হলো প্রকৃতজাত বিকারযুক্ত স্থুল বস্তু যা আমার প্রকৃত স্বরূপ নির্বিকার, নিরাকার আত্ম সত্ত্বাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট্। আর এই সৃষ্টির কারন হলো প্রকৃতির সুখ ও দুঃখ ভোগ করা। অর্থাৎ প্রকৃতি আত্মায় ভর করে জগতের সুখ ও দুঃখ ভোগ করে। সুতরাং সুখ ও দুঃখ দেহের আত্মার নয়। তাই সুখ ও দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন নিজ নির্বিকার, নিরাকার আত্ম সত্ত্বায় ফেরা্। অতএব সকল ভোগ বাসনা থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলে, নিজের আত্ম সত্ত্বায় ফেরা যায়। কারন মনের অভ্যন্তরে ভোগ বাসনার কামনা থেকেই আসে দেহ ধারন। তাই ভোগ বাসনা থেকে মনকে মুক্ত করতে পারলেই দেহ ধারন বন্ধ হয় এবং নিজ আত্ম স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, যাকে মুক্তি বা মোক্ষ বলে। সুতরাং নিজ আত্ম সত্ত্বায় থাকার নামই মুক্তি। এই আত্ম সত্ত্বায় ব্রহ্ম। তাই মুক্তিকে ব্রহ্ম প্রাপ্তি বলা হয়। তবে এই ব্রহ্ম সত্ত্বা শুধুমাত্র চেতন একটি পদার্থ নয়, ইনি জ্ঞানময় ও সর্বশক্তিমান এক চেতন সত্ত্বা যাকে  কেন্দ্র করে এবং যার শক্তিতেই সমস্ত কিছু সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশ হয়ে থাকে।
ওম

No comments:

Post a Comment